ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত এবং চীনকে নিয়ে তৈরি ব্রিকসের মঞ্চ। ব্রাজিলে চলছে ব্রিকসের সম্মেলন। সেখানে ব্রিকস দেশগুলো লিখিত সিদ্ধান্তে জানিয়েছে, ট্রাম্প সরকার যে নতুন শুল্কনীতি চালু করার কথা বলছে, তা তারা সমর্থন করে না।
ব্রিকসের এই সিদ্ধান্ত সম্প্রচারিত হওয়ার পরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, যে দেশ আমেরিকার শুল্কনীতির বিরোধিতা করবে, তাদের ওপর আরও ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।
ব্রিকস জোট নিয়ে আমেরিকা কখনোই খুশি নয়। কারণ এই মঞ্চে রাশিয়া এবং চীনের মতো শক্তি আছে। ভারতের ব্রিকসে থাকাও আমেরিকা খুব ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু ভারত বরাবরই আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভারসাম্য রক্ষা করেছে একইসঙ্গে আমেরিকা এবং রাশিয়ার সঙ্গে সমান সম্পর্ক বজায় রেখে।
সম্প্রতি সাংহাই কোঅপারেশনের বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। সেখানে সরাসরি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন রাজনাথ। পাশাপাশি সাংহাই কোঅপারেশনের লিখিত সিদ্ধান্তে ভারত পহেলগাম-কাণ্ডের উল্লেখ চেয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। যে কারণে ওই যৌথ সিদ্ধান্তে ভারত সই করেনি। বিশেষজ্ঞেরা সে সময় বলেছিলেন, বিশ্বের কাছে পাকিস্তানকে জড়িয়ে সন্ত্রাসের যে বার্তা ভারত দিতে চায়, সাংহাইয়ে সেই কাজে ব্যর্থ হয়েছে ভারত। ব্রিকস সম্মেলনের যৌথ সিদ্ধান্তে ভারত পহেলগামের কথা উল্লেখ করতে পেরেছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ একে ভারতের জয় বলেই মনে করছেন।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ অনিন্দ্যজ্যোতি মজুমদার এবিষয়ে জানিয়েছেন, “সাংহাই কোঅপারেশনের মঞ্চ এবং ব্রিকসের মঞ্চ এক নয়। ফলে এই দুই সম্মেলনকে একই ব্র্যাকেটে রাখা অনুচিত হবে। ব্রিকসের গুরুত্ব ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে ভারত পেহেলগামের কথা লিখিত সিদ্ধান্তে উল্লেখ করাতে পেরেছে, এটা নিঃসন্দেহে বড় ব্যাপার। ভারত নিজের অবস্থান তুলে ধরতে পেরেছে। কিন্তু একইসঙ্গে মনে রাখা উচিত, এতে ভূরাজনীতিতে কোনো আলোড়ন তৈরি হবে না।”
অনিন্দ্যের মতে, ভারত এই সাফল্য অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আলোড়ন ফেলবে সন্দেহ নেই, কিন্তু ভূরাজনীতিতে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ, ব্রিকসের মঞ্চে পাকিস্তান উপস্থিত নেই। সাংহাইয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি লড়াই করতে হয়েছে ভারতকে। ব্রিকসে তার প্রয়োজন হয়নি। ব্রিকসের প্রতিটি রাষ্ট্রই পেহেলগামের ঘটনার নিন্দা করেছিল আগে। আর ব্রিকসের সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের নাম কোথাও বলা হয়নি। ফলে, দক্ষিণ-এশিয়ার কূটনীতিতেও এর বিশেষ কোনো প্রভাব আছে বলে অনিন্দ্য মনে করেন না।
অনিন্দ্যের সঙ্গে সহমত ওপি জিন্দল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক তথা বিশিষ্ট কূটনীতি বিশ্লেষক শ্রীরাধা দত্ত। তিনি জানিয়েছেন, “সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ভারত বিশ্বমঞ্চে অনেককিছু করার চেষ্টা করলেও বাস্তবে তা ফলপ্রসূ হয়নি। পাকিস্তান নিয়ে পশ্চিমের দেশগুলোর অবস্থান ভারত বদলাতে পারেনি। ফলে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে ভারত এখন যা যা করছে, সবটাই দেশের গ্যালারির জন্য, এর বিশেষ কোনো প্রভাব ভূরাজনীতিতে পড়ছে না।”
কূটনৈতিক ভাষ্যকার প্রণয় শর্মা অবশ্য অনিন্দ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত নন। তিনি মনে করেন, কূটনৈতিক অবস্থানের জায়গা থেকে ব্রিকসের সিদ্ধান্তে পেহেলগামের উল্লেখ ভারতের ভূরাজনৈতিক সাফল্য হিসেবেই দেখা উচিত।
প্রণয় জানিয়েছেন, “স্বাভাবিকভাবেই সাংহাই কোঅপারেশনের রেজোলিউশনের সঙ্গে ব্রিকসের তুলনা টানা হচ্ছে। সাংহাইতে ভারত যেখানে ধাক্কা খেয়েছিল, ব্রিকসে সেখান থেকে ভারত খানিকটা উত্তরণের পথ তৈরি করতে পেরেছে, এটা বলাই যায়।”
প্রণয়ের বক্তব্য, ভূরাজনীতিতে গ্লোবাল সাউথ এখন একটি অন্যতম আলোচ্য বিষয়। ব্রিকস গ্লোবাল সাউথের গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। যে কারণে, পশ্চিমা বিশ্ব ব্রিকসের মঞ্চকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে দেখে। এই মঞ্চে ভারতের অবস্থান যে গুরুত্বপূর্ণ তা এবারেও প্রমাণ হয়েছে।
এবারের ব্রিকসের সিদ্ধান্তে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে। ইতোমধ্যেই বিশ্বরাজনীতিতে যা আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। ব্রিকসের সিদ্ধান্তে জানানো হয়েছে, তারা আমেরিকার শুল্কনীতির বিরোধিতা করছে। ট্রাম্প ইতোমধ্যেই এর জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিরোধিতা করলে আরও ১০ শতাংশ শুল্ক যুক্ত করা হবে।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের দফায় দফায় দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চলছে। আমেরিকা ভারতের কৃষিবাজারে প্রবেশের পরিবর্তে ভারতকে শুল্ক ছাড় দিতে চাইছে। অন্যদিকে ভারত আমেরিকাকে কৃষির বদলে অন্য সুযোগ দিয়ে শুল্কনীতি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে।
দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চলার মধ্যেই আমেরিকা জানিয়েছে, নতুন শুল্কনীতি ধার্যের মেয়াদ আরেকটু বাড়ানো হয়েছে। ৯ জুলাইয়ের পরিবর্তে ১ অগাস্ট পর্যন্ত সময়সীমা বর্ধিত করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারত সরাসরি ট্রাম্পের শুল্কনীতির বিরোধী মঞ্চে অংশ নেওয়ায় আমেরিকা আরেকটু কঠিন মনোভাব নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
অনিন্দ্যজ্যোতি মনে করেন, ব্রিকসের এই অবস্থানের প্রভাব ভারতের ওপর সরাসরি পড়তে পারে। রাশিয়ার কাছ থেকে ভারত তেল এবং গ্যাস কেনে। ফলে ব্রিকসে রাশিয়ার চাপ ভারতের ওপর আছে। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া এবং চীনের অবস্থানের বিরোধিতা করা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়।
অন্যদিকে, আমেরিকার সঙ্গে ভারসাম্যের রাজনীতি জারি রাখতে চায় ভারত। ব্রিকসের এই সিদ্ধান্তগ্রহণের পর শুল্ক নিয়ে ভারত-আমেরিকা দ্বিপাক্ষিক আলোচনা আরও জটিল হলো বলেই মনে করেন তিনি। ভারত আমেরিকাকে ভারসাম্যের পাল্লায় আনার জন্য অতিরিক্ত সুবিধা দেয় কিনা, তা-ও লক্ষ্যণীয় হবে বলে মনে করেন অনিন্দ্য।
প্রণয় মনে করেন, ট্রাম্প শুল্ক নিয়ে অন্য দেশের ওপর চাপ বজায় রাখতে চান। আমেরিকার কাছেও ব্রিকস গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিকসে আমেরিকা নেই, সেই মঞ্চে আমেরিকার সমালোচনা হচ্ছে, তারা গুরুত্ব পাচ্ছে, এটা তারা মেনে নিতে পারছে না। সেজন্য ট্রাম্পও হুমকি দিচ্ছেন।
শ্রীরাধা মনে করেন, শুল্কের ক্ষেত্রে ট্রাম্প একটি মানসিক যুদ্ধ বা সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার চালানোর চেষ্টা করছেন। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব কতটা, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে খেয়াল করা দরকার, এই বিষয়ে আমেরিকার সবচেয়ে বড় শত্রু চীন, তাদের সঙ্গে ট্রাম্প ইতোমধ্যেই একটি সমঝোতার রাস্তা তৈরি করার পথে হাঁটছেন।