রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর জুলাই সনদের খসড়া চূড়ান্ত করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। খসড়ায় একটি সংসদের মেয়াদ শেষ হলে বা কোনো কারণে সংসদ ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচন আয়োজনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কোন প্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হবে তারও পরিপূর্ণ রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। শনিবার (১৬ আগস্ট) রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো জুলাই সনদের খসড়া থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
জুলাই সনদের খসড়ায় নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের লক্ষ্যে সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদসহ একাধিক ধারা সংশোধনের সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রকাশ পেয়েছে।
প্রস্তাবিত এই ব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে নির্ধারণের জন্য সংসদীয় প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে একটি বাছাই কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে, যেখানে অংশ নেবেন সরকার ও বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, স্পিকার এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি।
খসড়ায় বলা হয়েছে, সংসদের মেয়াদ শেষে বা ভেঙে যাওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং নির্বাচন পরিচালনার জন্য একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হবে। প্রক্রিয়াটি ব্যর্থ হলে বিকল্প হিসেবে র্যাংকড চয়েজ পদ্ধতি, বিচার বিভাগের প্রতিনিধিত্ব এবং পূর্ববর্তী ভোটের ফলাফলের ভিত্তিতে প্রধান উপদেষ্টা মনোনয়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে,
বিদ্যমান সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে যেসব বিধান সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে–
(১) মেয়াদ অবসানের কারণে অথবা মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙ্গে যাওয়ার পরবর্তী নব্বই (৯০) দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
(২) সংবিধানের ৫৮ (খ) সংশোধনপূর্বক সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ১৫ দিন পূর্বে এবং মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙ্গে গেলে ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী পনের (১৫) দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।
(৩) মেয়াদ অবসানের ক্ষেত্রে সংসদের মেয়াদ অবসান হওয়ার ৩০ দিন পূর্বে জাতীয় সংসদের স্পিকারের তত্ত্বাবধানে এবং সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় — ১. প্রধানমন্ত্রী, ২. বিরোধী দলীয় নেতা, ৩. স্পিকার, ৪. ডেপুটি স্পিকার (বিরোধীদলের) এবং ৫. সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের একজন প্রতিনিধি— (যদি সংসদে আসন সংখ্যার বিবেচনায় একাধিক দল দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধীদলের অবস্থানে থাকে তাহলে সেসব দলের মধ্য থেকে নির্বাচনে সর্বোচ্চ পরিমাণে ভোটপ্রাপ্ত দলটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধীদল হিসেবে বিবেচিত হবে) মোট পাঁচ (৫) সদস্য সমন্বয়ে একটি ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি’ গঠিত হবে।
কমিটির যেকোনো বৈঠক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সভাপতিত্ব করবেন স্পিকার।
(৪) কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কমিটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলসমূহ, সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদের কাছ থেকে সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির নাম প্রস্তাবের আহ্বান করবেন এবং এক্ষেত্রে প্রতিটি দল এক জন এবং একজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য একজন ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করতে পারবে।
(৫) রাজনৈতিক দলসমূহ এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যগণ পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদ সচিবালয়ে তাদের প্রস্তাবিত নাম দাখিল করবেন।
(৬) পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কমিটির সদস্যগণ সভায় মিলিত হয়ে নিজেদের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত এবং রাজনৈতিক দলসমূহ ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে প্রস্তাবিত নামসমূহ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করত বাংলাদেশের যে সকল নাগরিক সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদ এর অধীনে উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্য তাদের মধ্য হতে একজনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নিবেন এবং তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।
(৭) বাছাই কমিটি গঠিত হওয়ার পরবর্তী ১২০ ঘণ্টার মধ্যে এ পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কোনো ব্যক্তিকে চূড়ান্ত করা সম্ভব না হলে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা পদের জন্য ৫৮গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্ত অনুসরণপূর্বক সংসদের সরকারি দল/জোট ৫ (পাঁচ) জন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে এবং প্রধান বিরোধী দল/জোট পাঁচ জন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে।
এছাড়া সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল দুই জন উপযুক্ত ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করবে।
যদি সংসদে আসন সংখ্যার বিবেচনায় একাধিক দল দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধীদলের অবস্থানে থাকে তাহলে সেসব দলের মধ্যে নির্বাচনে সর্বোচ্চ পরিমাণ ভোটপ্রাপ্ত দলটিই দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে বিবেচিত হবে। উপর্যুক্ত প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত নামসমূহ স্পিকার জনসাধারণের অবগতির জন্য প্রকাশ করবেন।
(৮) উপর্যুক্ত চ-এ বর্ণিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সরকারি দল/জোটের প্রস্তাবিত পাঁচ জন ব্যক্তির তালিকা থেকে প্রধান বিরোধী দল/জোট যেকোনো একজনকে বেছে নেবে;
অনুরূপভাবে প্রধান বিরোধী দল প্রস্তাবিত পাঁচ ব্যক্তির নামের তালিকা থেকে সরকারি দল যেকোনো এক জনকে বেছে নেবে। দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের প্রস্তাবিত মোট দুই জনের নামের তালিকা থেকে সরকারি দল/জোট যেকোনো একজনকে বেছে নেবে এবং প্রধান বিরোধী দল/জোট যেকোনো এক জনকে বেছে নেবে।
এই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত নামসমূহের মধ্য হতে যেকোনো একজনের ব্যাপারে যদি প্রস্তাবকারী দলগুলোর মধ্য ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তিনিই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে মনোনীত হবেন।
অথবা কোনো একজনের ব্যাপারে কমিটির পাঁচ জন সদস্যের মধ্যে যদি চার জন সদস্য একমত হন তাহলে তিনিই পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত হবেন।
(৯) যদি এই পদ্ধতিতে কোনো একজনের বিষয়ে প্রস্তাবকারী পক্ষসমূহ একমত হতে না পারে তাহলে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচার বিভাগের দুইজন প্রতিনিধি বাছাই কমিটিতে সদস্য হিসেবে যুক্ত হবেন এবং তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কারও নাম প্রস্তাব করতে পারবেন না।
এই দুইজন প্রতিনিধির মধ্যে একজন আপীল বিভাগের বিচারপতি হবেন এবং একজন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হবেন। বিচার বিভাগীয় প্রতিনিধিকে মনোনীত করার জন্য—১. সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, ২. কর্মরত প্রধান বিচারপতি এবং ৩. আপীল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি সমন্বয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠিত হবে।
(১০) এই পর্যায়ে সাত সদস্য বিশিষ্ট বাছাই কমিটির সদস্যরা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্পিকারের তত্ত্বাবধানে গোপন ব্যালটে ‘র্যাংকড চয়েজ’ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে যেকোনো একজনকে পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নেবেন।
(১১) উপর্যুক্ত যেকোনো পদ্ধতিতে মনোনীত ব্যক্তিকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতি পরবর্তী ৯০ দিনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগদান করবেন। তবে শর্ত থাকে যে, সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় তিনি শপথ গ্রহণ করবেন না।
(১২) উপর্যুক্ত পদ্ধতিসমূহের মাধ্যমেও যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বেছে নেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুসরণ করতে হবে; তবে শর্ত থাকে যে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বেছে নেওয়া যাবে না।
(১৩) কোনো কারণে প্রধান উপদেষ্টার পদ শূন্য হলে রাষ্ট্রপতি কোনো সময় ব্যতিরেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য পূর্ববর্তী র্যাংকড চয়েজ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগদান করবেন।
দ্বিতীয় স্থানে থাকা বয়সে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মতি জানালে অথবা দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে র্যাংকড চয়েজ বা ক্রমভিত্তিক ভোটিং পদ্ধতিতে পরবর্তী স্থানে থাকা ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য নিযুক্ত হবেন।
এই পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা পদে পরিবর্তন হলেও পূর্বতন উপদেষ্টা পরিষদ বহাল থাকবে। তবে উপদেষ্টা পরিষদের কোনো পদ শূন্য হলে নবনিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টা সেই শূন্যপদ পূরণের অধিকার রাখবেন।
(১৪) নিয়োগলাভের পর প্রধান উপদেষ্টা উপর্যুক্ত বাছাই কমিটির সঙ্গে পরামর্শক্রমে সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদে বর্ণিত উপযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্য হতে অনধিক ১৫ (পনেরো) জন ব্যক্তিকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের জন্য বেছে নেবেন এবং রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়োগ প্রদান করবেন।
(১৫) মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙ্গে গেলে, ভঙ্গ হওয়ার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদ সচিবালয়ের ব্যবস্থাপনায় বিলুপ্ত সংসদের একই ধরনের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই কমিটি’ গঠিত হবে এবং উক্ত কমিটি পরবর্তী ১৪ দিন তথা ৩৩৬ ঘণ্টার মধ্যে উক্তরূপ অভিন্ন পদ্ধতিতে এক জন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বেছে নিবে এবং তিনি অবিলম্বে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হবেন।
(১৬) সংবিধানের ৫৮(৭)(ঘ) সংশোধন করে “বাহাত্তর বৎসরের অধিক বয়স্ক নহেন” এর পরিবর্তে “পঁচাত্তর বৎসরের অধিক বয়স্ক নহেন” শব্দসমূহ প্রতিস্থাপিত হবে।
(১৭) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন এবং উপদেষ্টারা মন্ত্রীর পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।
(১৮) সংবিধানে বর্ণিত বিধানাবলি সাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব, কর্তব্য ও এখতিয়ার ও অবসানের সময়সীমা নির্ধারিত হবে।
(১৯) নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে অনধিক ৯০ দিন। তবে দৈব-দুর্বিপাকজনিত কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরও সর্বোচ্চ ৩০ দিন দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
(২০) নতুন সংসদ গঠিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী যে তারিখে তার পদের কার্যভার গ্রহণ করবেন সেই তারিখে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত হবে।
*ত্রয়োদশ সংশোধনীর অনুচ্ছেদ ৫৮(গ) (২) ব্যবস্থা বহাল থাকবে।