১৮৫০-এর দশকে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে রাশিয়া। সেই ঋণের বোঝা কিছুটা কমাতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে একটি রিয়েল এস্টেট চুক্তি করে রাশিয়া। তারা নিজেদের উপনিবেশ আলাস্কা আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দেয়।
আগামী শুক্রবার আলাস্কায় একটি শীর্ষ বৈঠকে বসবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই বৈঠকে তারা রাশিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আরেকটি কঠিন ও ব্যয়বহুল যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করবেন—যুদ্ধটি ক্রিমিয়াকে কেন্দ্র করে, যা ইউক্রেনের সঙ্গে সংঘাতে রাশিয়ার দখলে যাওয়া অঞ্চলগুলোর একটি।
আলাস্কায় বৈঠকের সিদ্ধান্ত মূলত বাস্তব কারণে নেওয়া হয়েছে। এটি এমন একটি জায়গা, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। দুই ভূখণ্ড বেরিং প্রণালীর মাত্র ৫৫ মাইল দূরত্ব দ্বারা তারা আলাদা। তবে ভৌগোলিক কারণ ছাড়াও এর রয়েছে প্রতীকী অর্থ ও এক চমকপ্রদ যৌথ ইতিহাস।
১৭৯৯ থেকে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত আলাস্কা ছিল পূর্ণাঙ্গ রুশ উপনিবেশ। ক্রেমলিনের দূত কিরিল দিমিত্রিয়েভসহ কিছু রুশ নাগরিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। তারা ১৯শ শতকে আলাস্কায় নির্মিত ও এখনো টিকে থাকা পেঁয়াজ আকৃতির গম্বুজযুক্ত রুশ অর্থোডক্স চার্চের ছবি পোস্ট করছেন।
আলাবামার মন্টগোমারির অবার্ন ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক এবং সিওয়ার্ড’স ফলি: এ নিউ লুক অ্যাট দ্য আলাস্কা পারচেজ বইয়ের লেখক লি ফ্যারো বলেন, ‘কিছু আমেরিকান হয়ত জানেন যে আমরা রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কিনেছিলাম, কিন্তু তারা হয়তো জানেন না যে এটি আসলেই একটি উপনিবেশ ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘এটি শুধু এমন একটি ভূখণ্ড ছিল না যেখানে [রুশরা] পতাকা গেঁড়ে দিয়েছিল। তাদের ক্যালিফোর্নিয়াতেও শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল।’
ফ্যারো এখানে ফোর্ট রসের কথা বলছিলেন—এটি ছিল রুশদের একটি ঘাঁটি, যা তারা এখনকার উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সোনোমা কাউন্টিতে প্রতিষ্ঠা করেছিল।
১৮৫৩–৫৬ সালের ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও অটোমান সাম্রাজ্যের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে পরাজয়ের পর যুদ্ধের ঋণ শোধ করার প্রয়োজন থেকেই রাশিয়া আলাস্কা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়।
ততদিনে আলাস্কার রুশ শিকারিরা মূল্যবান পশম ও চামড়ার জন্য সহজে পাওয়া যেত এমন বেশিরভাগ ভাল্লুক, নেকড়ে, ওটারসহ অন্যান্য প্রাণী শিকার করে শেষ করে ফেলেছিল। ফলে রাশিয়ার কাছে সেখানে থাকার তেমন কোনো অর্থনৈতিক কারণ অবশিষ্ট ছিল না।
আলাস্কা রাশিয়ার কাছে সম্পদের চেয়ে বোঝা বেশি মনে হয়েছিল এবং এটি ছিল রুশ সাম্রাজ্যের মানদণ্ডেও অত্যন্ত দুর্গম একটি এলাকা। একে কখনো কখনো ‘সাইবেরিয়ার সাইবেরিয়া’ বলা হতো।
১৮৬৭ সালের বসন্তে সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর যুক্তরাষ্ট্র ৭২ লাখ ডলার দিয়ে আলাস্কা কেনার চুক্তি করে—যা প্রতি একর জমির জন্য মাত্র ২ সেন্ট হয়। অর্ধেক মিলিয়নেরও বেশি বর্গমাইল এলাকা নিয়ে আলাস্কা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অঙ্গরাজ্য।
এই চুক্তিটি পরিচিতি পায় ‘সিওয়ার্ড’স ফলি’ নামে—তৎকালীন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু জনসনের আমলে চুক্তিটি করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম সিওয়ার্ডের নামানুসারে।
সমালোচকরা আলাস্কাকে ‘বরফাচ্ছন্ন জনমানবহীন প্রান্তর’ বলে উপহাস করলেও, ইতিহাসবিদ লি ফ্যারো জানান, তখনও এবং এখনো এ বর্ণনা সঠিক নয়।
সেই সময় যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত পশ্চিমমুখী সম্প্রসারণে থাকলেও, আলাস্কা কেনা দেশে তেমন বড় কোনো আলোড়ন তুলেনি। ওয়াশিংটনে কিছুটা রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল এবং কিছু সংবাদপত্র এর বিরোধিতা করেছিল, তবে এটি কখনো বড় কোনো রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠেনি, বলেন ফ্যারো।
যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সামান্য বিনিয়োগ
প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের অধীনস্থ অঞ্চল হিসেবে আলাস্কা এবং সেখানকার আদিবাসীরা প্রায় উপেক্ষিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেখানে খুব সামান্য বিনিয়োগ করেছিল, আর যে ক’জন আমেরিকান সেখানে গিয়েছিলেন তারা মূলত মিশনারি বা অভিযাত্রী ছিলেন, যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেদের ওপর নির্ভর করতেন।
আলাস্কার উন্নয়ন শুরু হয় কয়েক দশক পর। ১৮৯৬ সালে সেখানে স্বর্ণের সন্ধান মেলে, ১৯৫৯ সালে আলাস্কা অঙ্গরাজ্য হয়, আর ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে বিপুল তেলের মজুদ আবিষ্কৃত হয়।
আজও কিছু রুশ নাগরিক মনে করেন আলাস্কা তাদের হওয়া উচিত। ইতিহাসবিদ লি ফ্যারো জানান, ২০১৭ সালে বই প্রকাশের পর রাশিয়া সফরে গিয়ে বিভিন্ন শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি সবসময় একটি পূর্বানুমিত প্রশ্নের মুখোমুখি হতেন।
লি ফ্যারো বলেন, ‘প্রতিটি শ্রোতাগোষ্ঠীতে অন্তত একজন থাকত, যে জিজ্ঞাসা করত যুক্তরাষ্ট্র কি আসলেই বৈধভাবে আলাস্কা কিনেছিল কিনা। রাশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রবল ধারণা আছে যে আমরা হয়তো এর দাম পরিশোধ করিনি, অথবা এটি কেবল ভাড়ায় দেওয়া হয়েছিল, যা আমাদের এখনই ফেরত পাওয়া উচিত।’
ক্রিমিয়ার সংযোগ
আলাস্কা শান্তিপূর্ণভাবে হাতবদল হলেও, ক্রিমিয়া এমন একটি অঞ্চল যা কৃষ্ণ সাগরে উপদ্বীপ হিসেবে কৌশলগত অবস্থানের কারণে প্রায়ই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে।
রাশিয়া ১৮৫৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে কারণ তারা কৃষ্ণ সাগর ও আশপাশের অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চেয়েছিল। রাশিয়া দ্রুত এবং সহজ বিজয়ের প্রত্যাশা করেছিল এবং পশ্চিমা শক্তির হস্তক্ষেপের আশা করেনি।
তবে ব্রিটেন ও ফ্রান্স রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হয়ে যায় এবং রুশ সেনাবাহিনী জার নিখোলাস প্রথমের প্রত্যাশার তুলনায় অনেক দুর্বল প্রমাণিত হয়। রাশিয়া এক কঠিন পরাজয় ভোগ করে।
২০ শতকে ক্রিমিয়া ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ক্রিমিয়া স্বাধীন ইউক্রেনের অংশ হয়ে যায়।
এখন ২০১৪ সালে, পুতিন ইউক্রেনে আগ্রাসনের সময় ক্রিমিয়ায় রুশ সৈন্য পাঠান এবং প্রায় কোনও বড় যুদ্ধ ছাড়াই ওই অঞ্চল দখল করে নেন।
ইউক্রেন ক্রিমিয়া ফিরে পেতে চায় এবং সেখানে রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে নিয়মিত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে আসছে তারা। ক্রিমিয়া কোনো গুরুতর শান্তি আলোচনার অংশ হতে বাধ্য এবং এটি আসন্ন শুক্রবার ট্রাম্প-পুতিন শীর্ষ বৈঠকের আলোচ্যসূচিতেও থাকতে পারে।